‘ইল্মের মহানায়ক: ইমাম বুখারী
“আমায় মাপতে দাও অপরিমেয় উচ্চতা। কারণ শিখরে আরোহণ কষ্টসাধ্য, শেকড়ে বসা সহজ। তুমি চাও কষ্ট না করেই উপরে উঠতে, কিন্তু মৌমাছির হুল সহ্য না করে মধু সংগ্রহ করা যায় না।” জ্ঞানার্জন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের প্রতি এক রহমাত। আবু তামামের মতে (উপরের উক্তি), তা কিন্তু সহজ নয়। এখানে দরকার ধৈর্যশীলতা, সহিষ্ণুতা এবং সেই সাথে এটির প্রতি সুবিচার করার দক্ষতা। জ্ঞানার্জন তাই মূল্যবান রত্ন অর্জনের মতোন, যা কি না তার মালিককেই সংরক্ষণ করতে হয়। জ্ঞানার্জন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের প্রতি এক রহমাত। প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে। কীভাবে নম্রভাবে জ্ঞান অর্জন করা যায়, কীভাবে তা প্রয়োগ করা যায় এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, কীভাবে অন্যদের জন্যেও একই উপকার কামনা করে এটি প্রয়োগ করা সম্ভব? উত্তরটি আছে আমাদের মহান সাহাবা (রাঃ) এবং ইমামদের জীবনীতে। এমনই একজন ইমাম হচ্ছেন ইমাম বুখারী (রহিমাহুল্লাহ)। তবে চলুন আমরা তাঁর জ্ঞানের জাহাজে উঠে পড়ি এবং সেখান থেকে ভালো কিছু প্রাপ্তির খোঁজ করি, ইন শা আল্লাহ।
জ্ঞানার্জনের পথে যাত্রা
আবু ‘আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমা’ঈল ইবনে ইবরাহীম আল বুখারী ১৯৪ হিজরীতে বুখারা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন এবং একজন ইয়াতীম হিসেবে বেড়ে ওঠেন।
এক দশকের জীবন
কুরআন মুখস্থ করা, বেশ খানিকটা ফিক্বহ অধ্যয়ন করা ও আরবি ভাষা শেখার মাধ্যমে ১০ বছর বয়সেই ইমাম বুখারী একজন ‘আলিমে পরিণত হন। কিন্তু তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিলো হাদীস। ইমাম বুখারীর একজন ছাত্র একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, একবার ইমাম বুখারীর একজন শিক্ষক একটি হাদীসের বর্ণনাসূত্র বলতে ভুল করেছিলেন। ইমাম বুখারী ভুলটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। শায়েখ তাঁর ভুল স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানালেন। কিন্তু ইমাম বুখারীর চাপাচাপিতে তিনি বই বের করলেন এবং দেখলেন যে ইমাম বুখারীই ঠিক ছিলেন। সেই ঘটনার সময় ইমাম বুখারীর বয়স সম্পর্কে তাঁর ছাত্র জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বলেন, “আমার বয়স তখন ১০ এর বেশি হবে না …” কোনো কিছু পরীক্ষা না করে নিছক তোতাপাখির মতো তিনি কিছুই মুখস্থ করতেন না। তিনি যে শুধুমাত্র হাদীস এবং এর বর্ণনাসূত্রই জানতেন, তা নয়। বরং তিনি ‘রিজালশাস্ত্র’ তথা বর্ণনাকারীদের প্রত্যেকের ইতিবৃত্ত জানতেন। দেখেই মনে রাখার এক দারূণ দক্ষতাও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁকে দিয়েছেন, যা তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পথেই ব্যবহার করেছেন। তিনি শুধু বইয়ের পাতায় চোখ বোলাতেন এবং অন্য ছাত্রদের মতোন লিখে না রেখেই তা শেষ পর্যন্ত মুখস্থ করে নিতেন।
১৬ যখন হলো
ইমাম বুখারী যত শহরে গিয়েছেন, সেই সব শহরের ‘আলিমদের ‘ইল্ম সফলভাবে আহরণ করেছিলেন। শুধু বাকি ছিলো মক্কা এবং মদীনা। তাঁর সেই আশাও পূর্ণ হলো, যখন তাঁর মা এবং ভাই হাজ্জের জন্য যাত্রা করলেন। তিনি তাঁদের সঙ্গী হলেন এবং মদীনার সব ‘আলিমদের থেকে জ্ঞানায়ত্ত করলেন। তারপর মক্কার দিকে মনোনিবেশ করলেন। যখন বুখারায় ফেরার সময় হলো, তখন তিনি মক্কায় থেকে যাওয়ার বায়না ধরলেন। তাতে তাঁর মা সম্মত হলেন। ১৬ বছর বয়সেই তিনি হয়ে ওঠেন একজন ইমাম এবং ‘আল্লামা।
১৮ বছর বয়স
এই সময়ে তিনি তাঁর লেখালেখি শুরু করেন। মক্কাতে থাকাকালীন তিনি আত-তারীখ আল-কাবীর নামে হাদীস শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন, যা আজকের দিন পর্যন্ত সমান গুরুত্বপূর্ণ। বইটির নামের আক্ষরিক অনুবাদ দাঁড়ায় ‘বড় ইতিহাস’, যেখানে ইমাম বুখারী হাদীস বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে লিখেছেন। এটির পর তিনি আল-জামি’ আস-সহীহ আল-মুসনাদ মিন হাদীস রাসূলুল্লাহ ﷺওয়া সূনানিহি ওয়া আইয়ামিহি লিখেন, যা আজকের দিনে ‘সহীহ আল বুখারী’ নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ এক মানুষ, একনিষ্ঠভাবে বিশুদ্ধ হাদীস প্রচারকারী।
সহীহ আল বুখারী সংকলন
সহীহ আল বুখারী শেষ করতে ইমাম বুখারীর ১৬ বছর লেগেছিলো। তাঁর সংগ্রহগুলি সংকলনের সময় তাঁর ৭০০০০০ টি হাদীস মুখস্ত ছিলো। কিন্তু সেখান থেকে মাত্র ৭৫৬৩ টি হাদীস নিয়ে তিনি বইটি রচনা করেন। ৭৫৬৩ টি হাদীসের মধ্যে কোনোরকম পুনরাবৃত্তি ছাড়া মাত্র ২৫৫০ টি হাদীস আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইমাম বুখারী যদি খুব জ্ঞানীই হয়ে থাকেন, তবে কেন তিনি এটি শেষ করতে এত দীর্ঘ সময় ব্যয় করলেন? উত্তর হলো, তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে ভয় করে নির্ভুলভাবে তা করতে চেয়েছেন। ইমাম বুখারী বলেছেন যে, যখনই তিনি বইয়ে কিছু সংযোজন করেছেন, তখনই তিনি গোসল করে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে দু রাক’আত ইসতিখারার সালাত আদায় করেছেন। তাঁর একজন ছাত্র বর্ণনা করেন, “আমি কিছু রাত্রী ইমাম বুখারীর বাড়িতে ঘুমতাম। আমি দেখলাম যে, তিনি রাতে অন্তত ১৮ বার উঠেন এবং কিছু লেখালেখি করে আবার ঘুমাতে যান। তিনি তাঁর সংকলিত হাদীসগুলি সংশোধন করতেন।” এই নির্ভুলতার কারণেই ‘সহীহ আল বুখারী’র ভেতরের অধ্যায়ের শিরোনামগুলোও প্রজ্ঞায় ভরপুর। এমনই ছিলেন ইমাম বুখারী। তিনি ছিলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য একনিষ্ঠ। তিনি তাঁর সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে হাদীসগুলো সংরক্ষণ করেছেন। হাদীস বর্ণনাকারীদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব খবরাখবর না জেনে তিনি কারো কাছ থেকে একটি হাদীসও গ্রহণ করতেন না।
বিনম্রতা
‘আলিমদের জ্ঞান হচ্ছে জাররহ ওয়া তা'দিল। যার অর্থ হলো কোনো ব্যক্তি কি দ্বীনদার, নাকি মুরতাদ, নাকি শি’য়া, এসবের ভিত্তিতে তার বর্ণিত হাদীসকে সহীহ অথবা য’য়িফ হিসেবে চিহ্নিত করা। ‘আলিমগণ বলেছেন যে, কোনো পথভ্রষ্ট বা মিথ্যাবাদী ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে ইমাম বুখারী শুধু এতটুকুই বলতেন, “তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।” খারাপ লোক হিসেবে সর্বত্র পরিচিত লোকের ব্যাপারেও তিনি কখনোই খোলাখুলি কটূক্তি করতেন না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সামনে একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারার জন্যই তিনি এমনভাবে কথা বলতেন।
লেনদেন
ইমাম বুখারী একজন ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তাঁর সাথে সবাই ব্যবসা করতে ভালোবাসতেন। লোকসানের ক্ষেত্রেও তিনি খুবই স্বচ্ছভাবে লেনদেন করতেন। যখনই তাঁকে তাঁর অর্জিত সম্পদ থেকে কিছু জমানোর কথা বলা হতো, তখনই তিনি উত্তর দিতেন, “আমার জন্য আল্লাহর নিকট যা আছে, তা এগুলো থেকে উত্তম।”
দুঃখ-দুর্দশা
আয যুহালী নামের একজন ‘আলিম তাঁর ছাত্রদের ইমাম বুখারীর নিকট হাদীস শুনতে পাঠান। কিন্তু যুহালীর ছাত্ররা ইমাম বুখারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং আর ফেরত যান না। এটি তাঁকে ইমামের বিরুদ্ধে হিংসুটে করে তোলে। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা শুরু করেন। তিনি বলেন যে, ইমাম বুখারী কুরআনকে সৃষ্ট বলে বিশ্বাস করেন। কুরআনকে আল্লাহ্র কালামের বদলে আল্লাহ্র সৃষ্টি বলে বিশ্বাস করাটা সে যুগের সবচেয়ে বড় ফিতনা ছিলো। ইমামের একটি হালাকা চলাকালীন একজন প্রশ্নকারী বারবার এই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন। বেশ কয়েকবার উপেক্ষা করার পর ইমাম বুখারী অবশেষে উত্তর দিলেন, “কুরআন আল্লাহ্র কালাম এবং কন্ঠস্বর আল্লাহ্র একটি সৃষ্টি আর আমাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা বিদ’আত।” ইমামকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করার জন্য অজ্ঞ লোকটির কাছে এই উক্তিটিই যথেষ্ট ছিলো। যখন ইমাম বুখারীর একজন ছাত্র, আহমাদ তাঁকে এই অপবাদ সম্পর্কে বলায় তিনি জবাব দেন, “যে কুরআনকে সৃষ্ট বলবে, সে কাফির; এবং যে একজন মুসলিমকে কাফির বলবে, সেও কাফির।” আহমাদ তাঁকে লোকটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলায় ইমাম উত্তর দেন, “আমি এটি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম। দুর্দশা এবং প্রতিবন্ধতার সময় ধৈর্যধারণ করার ব্যাপারে রাসূল ﷺ এর সেই হাদীসটি কি তুমি জানো না?” আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে তিনি একমাত্র এই দু’আ করতেন যে, “হে আল্লাহ, আমি এই লোকদের শিক্ষা দিতে আমার শহর ত্যাগ করেছি। তারা হিংসার বশবর্তী হয়ে আমার সম্পর্কে এসব বলে এবং তুমি তো জানো এসব মিথ্যা।”
ঘরের ছেলে ঘরে
ইমাম বুখারী তাঁর জন্মস্থান বুখারায় ফেরত আসলেন যেখানে তাঁকে ভালোবাসা এবং সম্মানের সাথে সম্ভাষণ জানানো হলো। তিনি আবারও পাঠদান শুরু করলেন এবং তাঁর ছাত্র সংখ্যা বাড়তে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে ইমাম বুখারীকে বুখারার শাসক আদেশ দিলেন তাঁর সন্তানদেরকে সহীহ আল বুখারী এবং তারিখ আল কাবীর পড়াতে। ইমাম বুখারী এই বলে তা প্রত্যাখ্যান করলেন, “রাজপ্রাসাদে পা দেওয়ার চেয়ে একটি জিফা খাওয়া উত্তম।” তিনি আরো বলেন, “যদি আপনি আমার উত্তর পছন্দ না করেন, তবে আমাকে জ্ঞান দান করা থেকে বিরত রাখুন যাতে আল্লাহর কাছে পেশ করার মতো আমার একটি ওজর থাকে।” অতঃপর ইমাম বুখারীকে বুখারা থেকে বের করে দেওয়া হয়।
জীবনসায়াহ্নে
বের করে দেওয়ার পর ইমাম বুখারী তাঁর এক বন্ধুর কাছে সামারকান্দে থাকতেন। কিছুকাল পর তাঁকে বুখারার শাসক ডেকে পাঠান। এই সময়ে ইমাম বুখারী আল্লাহর নিকট দু’আ করেন, “হে আল্লাহ, আমাকে তার মুখোমুখি করবেন না; এবং আমার আত্মাকে নিয়ে নিন।” এর কিছুকাল পর তিনি ৬২ বছর বয়সে একাকী মৃত্যুবরণ করেন। ইমাম বুখারীর জীবন ছিলো কেবলমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য। তিনি ১০৮০ জন শিক্ষক থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁকে বাঁধভাঙা জ্ঞান এবং খ্যাতি দিয়েছেন, তারপরও তিনি ছিলেন নিরহংকার। আল্লাহভীরুতা কখনো তাঁকে ছেড়ে যায়নি। ইনারাই আমাদের মহান ইমাম, যারা আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং ভালোবাসা অর্জনের মধ্যে থাকা মিষ্টতা এবং আনন্দের কথা বারবার শিখিয়েছেন এবং মনে করিয়ে দিয়েছেন। শায়েখ আবদুল ‘আযীয ইবনে বাযের নিচের উক্তিটি সে সব কিছুর সমষ্টি, যার জন্য প্রতিটি জ্ঞানপিপাসু ছাত্রকে সংগ্রাম করতে হয়: “হে আল্লাহর বান্দা! হে ত্বলিবুল ‘ইল্ম! শুধুমাত্র আল্লাহ্র জন্য তোমার ‘ইবাদাতে আন্তরিক হওয়া তো তোমারই দায়িত্ব। তোমাকে অবশ্যই হতে হবে আন্তরিক এবং অধ্যবসয়ের সাথে জ্ঞানার্জনে লেগে থাকতে হবে। অতঃপর জ্ঞান অর্জনের শর্ত পূরণ করতে হবে (অর্থাৎ জ্ঞানকে কাজে পরিণত করতে হবে)। কারণ ‘ইল্মকে ‘আমালে পরিণত করাটাই লক্ষ্য, ‘আলিম হওয়া বা উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করা লক্ষ্য নয়। বস্তুত, জ্ঞানার্জনের মূল লক্ষ্য তো এই যে, তুমি সেই অনুযায়ী কাজ করবে, মানুষকে ভালো কিছু শিক্ষা দেবে, ফলস্বরূপ মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান করে তুমি হবে নবীদের উত্তরাধিকারী।”
লেখক: আয়িশাহ আহমেদ অনুবাদক: আফরিন আফরোজা (MBBS student, Jessore Medical College)